শিক্ষাঙ্গনে ত্রিমুখী সহিংসতার শঙ্কা
ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় :
২৩-০২-২০২৫ ০৯:০৩:১৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
২৩-০২-২০২৫ ০৯:০৩:১৭ অপরাহ্ন
কোলাজ: সংগৃহীত
জুলাই অভ্যুত্থানের সাড়ে ছয় মাস পার হলেও ছাত্ররাজনীতিতে কাঙ্ক্ষিত নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়নি। বরং ছাত্রসংগঠনগুলো নিজেদের বলয় তৈরি করতে ব্যস্ত এবং প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলোর নেতাদের প্রতি তির্যক মন্তব্য করতেও দেখা যাচ্ছে। এক সংগঠনের নেতারা প্রতিপক্ষ সংগঠনের নেতাদের ‘সন্ত্রাসী’, ‘গুপ্ত সংগঠন’সহ বিভিন্ন বিশেষণে অভিহিত করছেন।
শেখ হাসিনার শাসনামলে ছাত্রলীগ একক আধিপত্য বিস্তার করেছিল। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছাত্ররাজনীতির নতুন কাঠামো গঠনের আলোচনা হলেও বাস্তবে সেই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যকার ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সংঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এক সংগঠন অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। আর এই ত্রিমুখী চাপের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। সর্বশেষ রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে চট্টগ্রাম কলেজে লিফলেট বিতরণ করতে গেলে একদল শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে ছাত্রদল। এসময় ছাত্রদলের কয়েকজনকে মারধর করা হয়। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় ছাত্রশিবির জড়িত। তবে ছাত্রশিবির তাদের এ দাবিটি নাকচ করেছে।
ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব ও সংঘাতময় পরিস্থিতি
জুলাই আন্দোলনের পর ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা একে অপরের বিরুদ্ধে সমালোচনায় লিপ্ত হয়েছেন। ছাত্রদলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শিবিরের বিরুদ্ধে ‘গোপন রাজনীতি’ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রুপে এই দুই পক্ষের অনুসারীরা ব্যাপক বিতর্কে জড়িয়েছেন। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে প্রশাসনের বৈঠকে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির পরস্পরবিরোধী অবস্থান নেয়। এমনকি বাম ছাত্রসংগঠনগুলোও শিবিরের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
কুয়েট সংঘর্ষ; সহিংসতার নতুন মাত্রা
গত মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্রদলের সমর্থকরা ফরম বিতরণ করছিলেন। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। বহিরাগত যুবদল কর্মীদের হামলায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। এক যুবদল নেতাকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার টিএসসিতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন করে এই ঘটনার জন্য ছাত্রশিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে দায়ী করেন। এমনকি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাকিবুল ইসলাম পাশে দাঁড়িয়ে নাছির উদ্দীনকে বলেন, শিবিরের ওপর দায় দিয়ে দাও। নাছির উদ্দীন বলেন, ‘বাংলাদেশে যত বড় বড় অগ্নিকাণ্ড হয়েছে, তার সূচনা ছিল ছোট ছোট শর্ট সার্কিট থেকে। গতকাল সেই কাজ শুরু করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশৃঙ্খল মব। নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় আহ্বায়ক ওমর ফারুক এবং কেন্দ্রীয়ভাবে এটি মনিটর করেছে সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। অন্যদিকে, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, ছাত্রদল ভুল পথে হাঁটছে। তাদের উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুনভাবে এগিয়ে যাওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া
কুয়েট সংঘর্ষের প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। সংগঠনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘গত ১৬ বছরে নির্যাতনের কথা ভুলে যাবেন না। ক্যাম্পাসে চাপাতির রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ছাত্রলীগ যে পথে গেছে, ছাত্রদলও সে পথেই যাবে।’
এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক আব্দুল কাদের বলেন, যারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চায়, তারা নিজেরাই শিবিরের কমিটিতে সভাপতি-সেক্রেটারি হয়ে যাচ্ছে! শিবির যদি হল কমিটি প্রকাশ করে, তাহলে আরও ভয়াবহ চিত্র দেখা যাবে। তিনি আরও বলেন, শিবিরকে এখনই গোপন রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যদি নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি করতে হয়, তবে প্রকাশ্যে করতে হবে। গুপ্তভাবে রাজনীতি করে অন্যদের নিষিদ্ধ করতে চাইলে সংঘাত হবেই।
এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে রগ কাটার অভিযোগ ছিল ‘গুজব’
গত বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) মধ্যরাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের একটি মন্তব্যের (কমেন্ট) জেরে সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ ছাত্রাবাসে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তারা হলেন- মিজানুর রহমান রিয়াদ ও জাহিদুল ইসলাম হৃদয়। এ ঘটনায় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ হামলায় আহতের একজন মিজানুর রহমান রিয়াদ। ঘটনার পর ফেসবুকে তার পায়ের রগ কাটা হয়েছে বলে ছড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তীতে এ নিয়ে বিবৃতিও দিয়েছে ছাত্রদলসহ একাধিক সংগঠন। তবে শাখা ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে উঠা এই অভিযোগ নিয়ে সাংবাদিকদের কথা হয় এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল আনাম মো. রিয়াজের সঙ্গে। ঘটনার পরদিন রাতে চিকিৎসকের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, আহত শিক্ষার্থীর পায়ের রগ কাটার মত কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার ঘটনা; আরেকটি সংঘাতের ইঙ্গিত
কুয়েট সংঘর্ষের পরদিনই তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার একটি ইউনিটের শিবির সভাপতিকে ছাত্রদলের কয়েকজন কর্মী মারধর করে। কিন্তু ছাত্রদল এ ঘটনার দায় এড়িয়ে গিয়ে বলেছে, এটি ছিল ব্যক্তিগত বিরোধের জের। অন্যদিকে, অভিযোগ রয়েছে যে, শিবিরের ওই নেতাকে জোর করে সিগারেট ধরিয়ে ছবি তোলা হয় এবং তাকে দিয়ে ভিডিওতে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয় যে তিনি শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন।
বিভক্তির শঙ্কা ও প্রতিক্রিয়া
শিবিরের কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক সাদিক কায়েম লিখেছেন, ৩৬ জুলাইয়ের পূর্ববর্তী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্ম আর বর্তমান প্ল্যাটফর্ম এক নয়। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনায় তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই তারা শিবিরের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। অথচ তামিরুল মিল্লাতের ঘটনায় তারা চুপ থেকেছে। তিনি আরও বলেন, তামিরুল মিল্লাতের শিক্ষার্থীকে গুরুতর আহত করা, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেওয়া এবং থানায় অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নীরবতা প্রমাণ করে যে, এটি তাদের সাংগঠনিক অবস্থান। এত দ্রুত তারা শহীদদের আদর্শ ভুলে যাবে, তা ভাবিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক এক শিক্ষার্থী বলেন, প্রত্যেককে নিজ সংগঠনের রাজনীতি করতে দিতে হবে, তবে চাপ প্রয়োগ করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা যাবে না। শিবিরের একটি অংশ ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করছে, আবার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ছাত্রদলকে কোণঠাসা করতে চাইছে। কিন্তু কে কীভাবে সংগঠন পরিচালনা করবে, তা তাদের নিজস্ব বিষয়। দলীয় রাজনীতি বা লেজুড়বৃত্তি নিয়ে একে অপরকে আক্রমণ করলে সংঘাত বাড়বে। তিনি আরও বলেন, রাজনীতিতে আগ্রহী নয় এমন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে অবৈধ সুবিধা দেওয়া যাবে না। সব সংগঠন প্রকাশ্যে রাজনীতি করলে শিক্ষার্থীরা বিচার করতে পারবে কোনটি ভালো, কোনটি মন্দ।
ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন বলেন, সব পক্ষকে সহনশীল হতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি না করে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক চর্চা করতে হবে।
ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, সংঘাত আমাদের জন্য কোনো সমাধান নয়। মতানৈক্য থাকলেও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। আধিপত্য বিস্তার বন্ধ করতে হবে, আর সংকট নিরসনে সবাইকে সংলাপে বসতে হবে।
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এএইচ/এসকে
প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স